◆গীতিকাব্য বলতে কি বোঝ? সংস্কৃত গীতিকাব্য সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ রচনা কর।
বৈদিক যুগ থেকেই গান ভারতবর্ষের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু। সামবেদের গানের কথা কারই অজানা নয়। তাই বলা হয়- “ন বিদ্যা সঙ্গীতাৎ পরা”। যে কাব্য গানের মাধ্যমে পাঠ করা হয়, তাকেই সাধারনভাবে গীতিকাব্য বলে। গীতিকাব্যের মধ্যে কবির স্বত:স্ফূর্ত হৃদয়াবেগ প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত গীতিকাব্যের ইতিহাস-“মেঘদূত”,”ঋতুসংহার”,”গীতগোবিন্দম্”,”গাথাসপ্তশতী”,”শৃঙ্গার-শতকম্”,”সূর্যশতকম্”,”চৌরপঞ্চাশিকা” প্রভৃতি কাব্যগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সংস্কৃত গীতিকাব্য তিনভাগে বিভক্ত ।যথা-¡) প্রেমমূলক গীতিকাব্য,¡¡) ভক্তিমূলক গীতিকাব্য, ¡¡¡) নীতিমূলক গীতিকাব্য।
(১) মেঘদূতম্:-
সরস্বতীর বরপুত্র মহাকবি কালিদাসের অপরাসৃষ্টি “মেঘদূতম্” প্রেমমূলক গীতিকাব্যের সর্বশ্রেষ্ট নিদর্শন।
“মন্দাক্রান্তা” রচিত এই কাব্যটি পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এই দুই অড়শে বিভক্ত। হিমালয়ের বক্ষে অলকাপুরীতে কোনো এক যক্ষ আপন কর্তব্য অবহেলার দায়ে প্রভু কুবেরের অভিশাপে এক বৎসরের জন্য নির্বাসিত হয়েছিল দক্ষিণভারতের রামগিরি পর্বতে।
প্রিয়াবেদনায় ব্যকুল যক্ষ সেখানে আটমাস কাটানোর পর -“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” আকাশে মেঘ দেখে চেতন-অচেতন জ্ঞান হারিয়ে মেঘের দ্বারাই নিজের কুশলময় সংবাদ প্রিয়ার কাছে পাঠাতে চাইল। এরপর আছে রামগিরি পর্বত থেকে অলকাপুরী পর্যন্ত মেঘের যাত্রাপথের বর্ণনা । উত্তর মেঘে আছে অলকাপুরীর বর্ণনা এবং যক্ষ প্রিয়ার অপরূপ-রূপলাব্যনের বর্ণনা।
(২) ঋতুসংহারম্:-
মহাকবি কালিদাস-এর “ঋতুসংহারম্” গীতিকাব্যটিও সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ছয়টি ঋতুর বর্ণনামূলক এই গীতিকাব্যটির ভাষা অত্যন্ত সহজ। তাই বিখ্যাত টীকাকার মল্লিনাথ এই কাব্যের কোনো টীকা রচনা করেননি। ছয়টি পৃথক সর্গে ছয়টি ঋতুর বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রতিটি ঋতুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি জগতে যে পটপরিবর্তন ঘটে “ঋতুসংহারম্” গীতিকাব্যটিতে মহাকবি কালিদাস অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তা চিত্রিত করেছেন।
(৩) গীতগোবিন্দম্:-
কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দম্” কোমলকান্ত পদাবলীর কাব্য। রাধাকৃষ্নের শাশ্বত প্রেমলীলাকে উপজীব্য করে রচিত এই কাব্যটি ভক্তিমূলক গীতিকাব্যের সর্বশ্রেষ্ট নিদর্শন। কাব্যটিতে ১২টি সর্গ, ৮০টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমাবেশ ঘটেছে। কাব্যের গানগুলির ভাষা অতিমধুর ও হৃদয়গ্রহী। কবি সতেন্দ্রনাথ দত্ত এই কাব্য পাঠ করে ছন্দলালিত্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন-
“বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্তকোমলপদে।
করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন কোকনদে।।”
(৪) গাথাসপ্তশতী:-
সাতবাহন রচিত “গাথাসপ্তশতী” গীতিকাব্যের অপূর্ব নিদর্শন।
প্রাকৃত ভাষায় রচিত সাতশতশ্লোক সমন্বিত এই গীতিকাব্যটি প্রেমের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। ঋকবেদে যম-যমী, ঊর্বশী- পুরূরবার প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই প্রেমের কাহিনী সাতবাহন তার “গাথাসপ্তশতী” গীতিকাব্যে চিত্রিত করেছেন।
(৫) শৃঙ্গারশতকম্:-
ভর্তৃহরি রচিত “শৃঙ্গারশতকম্”,”নীতিশতকম্” ও “বৈরাগ্যশতকম্” কাব্যগুলি গীতিকাব্যের অন্তর্গত। এগুলিও প্রেমমূলক গীতিকাব্য। কাব্যগুলি থেকে জানা যায় প্রেমের মধুরতার থেকে জীবনের দাম কবির কাছে অনেক বেশি ছিল।
(৬) সূর্যশতক:-
ময়ূরভট্টের লেখা “সূর্যশতকম্” সূর্যদেবের স্তুতি বিষয়ক ধর্মমূলক গীতিকাব্য।
একশত শ্লোকে ময়ুরভট্ট সূর্যদেবের স্তব করেছেন । এইকাব্য রচনা করে কবি দূরারোজ্ঞ পুষ্টব্যাধি হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। এই কাব্যের প্রতিটি শ্লোক “স্রগ্ধরা” ছন্দে রচিত।
(৭) চৌরপঞ্চাশিকা:-
কাশ্মীরি কবি বিলহন-এর লেখা “চৌরপঞ্চাশিকা” গীতিকাব্যটি ৫০টি শ্লোকে রচিত। এই গ্রন্থে প্রেমিক- প্রেমিকার পূর্বস্মৃতির কাব্যরূপ প্রকাশিত হয়েছে। গোপন প্রেমকে অবলম্বন করে কাব্যটি রচিত।
গোপন প্রেমে ধরা পড়ে কবি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি সেখানেই মুখে মুখে প্রেমিকা চন্দ্রলেখার উদ্দেশ্যে-পঞ্চাশটি শ্লোক রচনা করেন। রাজা একথা জানতে পেরে কবির কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি দেন। অবশেষে প্রসন্ন চিত্তে নিজকন্যা চন্দ্রলেখাকে কবির হাতে সমর্পণ করেন । কাব্যটির রচনাকৌশল অত্যন্ত সরল ও হৃদয়গ্রাহী।
***
Discussion about this post