◆ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে ” মহাভারত ”-এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।
Discuss the influence of the Mahabharata on Indian society and literature
সূচনা:-
মহর্ষি কৃষ্নদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস প্রণীত কালজয়ী মহাকাব্য “মহাভারত”।যুগ যুগ ধরে আপামোর ভারতবাসী “মহাভারত”-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আসছে। ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা “মহাভারত”-এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। পাশ্চাত্য সমালোচক অ্যানিবেসান্ত বলেছেন- ” Mahabharata is the great poem in the whole word ”. কথিত হয় জাতীর যথার্থ পরিচয় বহন করে তার সাহিত্য। “মহাভারত”-এর মধ্যেও ভারতীয় জীবনাদর্শের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
▪সমাজ জীবনে প্রভাব:-
ভারতীয় সমাজ জীবনে ও জনচিত্তে “মহাভারত”-এর প্রভাব যুগযুগ ধরে অব্যাহত রয়েছে। “ভীষ্মের স্বার্থত্যাগ”, “কর্ণের দানশীলতা”, “যুধিষ্টিরের সত্যনিষ্টা”, “পান্ডবদের ভ্রাতৃভক্তি”, “দ্রৌপদীর তেজস্বীতা” প্রভৃতি বিভিন্ন চরিত্রের বিবিধ গুনাবলী ভারতীয় জনজীবনে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। “ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা”, “দাতাকর্ণ”, “সত্যবাদী যুধিষ্ঠির”, “শকুনিমামা”, “বিদুরের খুদ” প্রভৃতি প্রবাদবচনগুলি ভারতীয় জনজীবনে প্রতিনিয়তই শোনা যায়। “মহাভারত” পাঠ ও শ্রবণে পাপ দূরীভূত হয়- এই বিশ্বাস হিন্দুদের মনে চিরন্তন। “মহাভারত”-এর ভীষ্মপর্বে অবস্থিত “শ্রীমদভগবদগীতা” হিন্দুদের শ্রেষ্ট দর্শনশাস্ত্র। হিন্দুদের শ্রাদ্ধ বাড়িতে “মহাভারত”-এর বিরাটপর্ব পাঠ করা হয়।
▪সাহিত্যে প্রভাব:-
শুধু সমাজ জীবনেই নয়, পরবর্তীকালের কবি ও নাট্যকারদের কাছে “মহাভারত” অত্যন্ত আদরের বস্তু। সংস্কৃত সাহিত্যে “মহাভারত”-এর প্রভাব অপরিসীম। এছাড়াও আধুনিক বাংলাসাহিত্য, সাম্প্রতিক কালের যাত্রাপালাগান, এমনকি চলচ্চিত্র, বেতার ও দূরদর্শনেও “মহাভারত”-এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। “মহাভারত” সম্বন্ধে ব্যাসদেবের প্রত্যাশাই ছিল-
“সর্বেষাং কবিমুখ্যানাম্ উপজীব্য ভবিষ্যতি।
পর্জন্য ইব ভুতানাম্ অক্ষয়ো ভরতর্ষভ:।”
▪সংস্কৃত সাহিত্যে প্রভাব:-
প্রথিতযশা নাট্যকার ভাসের “দূতবাক্যম্”, “কর্ণভারম্”,”পঞ্চরাত্রম্”,”ঊরূভঙ্গম্”,”দূ-তঘটোৎকচম্” এবং “মধ্যমব্যায়োগম্” প্রভৃতি নাটকগুলির কাহিনী মহাভারত থেকে সংগৃহীত। মহাকবি কালিদাসের “অভিজ্ঞানশকুন্তলম্” এবং “বিক্রমোর্বশীয়ম্” নাটক, ভারবির “কিরাতার্জুনীয়ম্” মহাকাব্য, মাঘের “শিশুপালবধ” কাব্য, শ্রীহর্ষের “নৈষধচরিত”, ভট্টনারায়ণের “বেনীসংহার” প্রভৃতি গ্রন্থগুলির কাহিনী “মহাভারত” থেকেই সংগৃহীত হয়েছে।
▪আধুনিক বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস:-
বাংলা ভাষায় রচিত কাশিরাম দাসের “মহাভারত” বাঙালির ঘরে ঘরে পঠিত হয়। এছাড়াও কবি মধুসূদন দত্তের “বীরাঙ্গনা” কাব্য ও “শর্মিষ্ঠা” নাটক, হেমচন্দ্রের “বিত্রসংহার”, রবীনদ্রনাথের “চিত্রাঙ্গদা”, “কর্ণকুন্তিসংবাদ”,”গান্ধারীর আবেদন” প্রভৃতি রচনাগুলির বিষয়বস্তু “মহাভারত” থেকেই সংগৃহিত। গিরীশচন্দ্রঘোষের “জনা”, “পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস” প্রভৃতি নাটকগুলির কাহিনীও “মহাভারত” থেকেই নেওয়া হয়েছে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাশিরাম দাসকে প্রণাম জানিয়ে বলেছেন-
“মহাভারতের কথা অমৃত সমান
হে কাশিকবি সদলে তুমি পূণ্যবান।।”
▪সাম্প্রতিক কালের যাত্রাপালাগান:-
সাম্প্রতিক কালের বাংলা নাটকে এবং যাত্রাপালায় “মহাভারত”-এর বিভিন্ন কাহিনি নানাভাবে উপস্থিত হয়েছে। যেমন-“সারথি”,”কর্ণাজুন”,”কুরূক্ষেত্রে কর্ণ”,”দ্রৌপদী”,”শকুনিমামা”,”দানবীর কর্ণ” প্রভৃতি নাটক ও যাত্রাপালাগুলির বিষয়বস্তু “মহাভারত” থেকেই সংগৃহিত হয়েছে।
মূল্যায়ন:-
“মহাভারত” ভারতবর্ষের জাতীয় সাহিত্য। কথিত হয় সাহিত্যই জাতির যথার্থ পরিচয় বহন করে, তাই “মহাভারত-এর মধ্যে অনুভূত হয় ভারতীয় আদর্শের চিরন্তন হৃদস্পন্দন। কর্ম ও ভক্তির অপূর্ব সংযমতীর্থ “শ্রীমদভগবদগীতা” মহাভারত-এরই অন্তর্গত। ভারতীয় সমাজ,সাহিত্য ও শিল্প যুগ যুগ ধরে “মহাভারত” থেকে প্রাণ সত্ত্বার অপরিহার্য শক্তি আহরন করেছে। সুতরাং, ভারতবর্ষকে জানতে , ভারতীয় মানসিকতাকে বুঝতে হলে “মহাভারত”-কে অবশ্যই জানতে হবে। মহর্ষি বৈশম্পায়ন তাই যথার্থই বলেছেন-
“ধর্মে চ অর্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ:।
যদি হাস্তি তদন্যত্র যন্নে হাস্তি ন কুত্রচিৎ।।”
——————————————————————————————————————————————–
Discussion about this post