মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুণাঃ – উক্তিটির যথার্থতা

উপমা কালিদাসস‍্য ভারবেরর্থগৌরবম্। নৈষধে পদলালিত‍্যং মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুণাঃ  – উক্তিটির যথার্থতা বিচার করো।

মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুণাঃ – উক্তিটির যথার্থতা বিচার করো।


উঃ- কালিদাসোত্তর যুগের যে কয়েকজন মহাকবি আলোকসামান্য প্রতিভার নির্ঝরিনী ধারা সৃষ্টি করে স্বহৃদয় আকাশে প্রজ্বলিত সমুজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত চির বিরাজমান। মহাকবি মাঘ তাদের অন্যতম শিশুপালবধ নামে একটি মাত্র মহাকাব্য রচনা করে সুকুমার কল্পনার ঐশ্বর্যে কাব্যিক সৌন্দর্য ও মাধুর্যের যে বিশাল জগতের সৃষ্টি করেছেন তা সমালোচকদের সমালোচনার কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত হয়ে কালোকীর্ন সাহিত্যসৃষ্টি রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে।


ভারবির কবি খ‍্যাতিকে ম্লান করবার পরিকল্পনা নিয়েই মহাকবি মাঘ রচনা করেছিলেন তার শিশুপালবধ মহাকাব্য এবং এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য সার্থক সাফল্য লাভ করেছিল সমসাময়িক সমালোচকদের এই উক্তিটিই তা প্রমাণিত হয় –


“তাবদ্ভা ভারবের্ভাতি যাবন্মাঘস‍্য নোদয়ঃ।
উদিতে চ পুনর্মাঘে ভারবের্ভাতি রবেরিব।”


মাঘের কাব্যে তার তিন পূর্বসূরী কালিদাস ভারবি শ্রীহর্ষের – উপমা অর্থগৌরব ও পদলালিত‍্য এই ত্রিবিধ কাব‍্যগুনের স্বার্থক অস্তিত্ব পর্যবেক্ষন করে সমালোচকরা সপ্রসঙ্গ মন্তব্য করেছেন-


“উপমা কালিদাসস‍্য ভারবেরর্থগৌরবম্।
নৈষধে পদলালিত‍্যং মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুণাঃ ।।’


এখানে উল্লেখযোগ্য যে কোন সমালোচক মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুনাঃ -বাক্যটির এরকম অর্থ করেন যে অলঙ্কারশাস্ত্র দশটি গুণ এর মধ্যে মাত্র তিনটি গুণের অধিকারী কিন্তু এর অর্থ অসঙ্গত।

কারণ মল্লিনাথ

“আচার্যোক্তা দশগুনাঃ প্রায়েনাত্র সম্ভবন্তি।”

সুতরাং বাক‍্যটির প্রকৃতার্থ হল মহাকাব্য শিশুপালবধ অলঙ্কারশাস্ত্রোক্ত দশবিধগুন ছাড়াও একাধারে উপমা অর্থগৌরব এবং পদলালিত্য এই তিন গুণের প্রতিভার অধিকারী এখানে সমালোচকদের প্রধান বিবক্ষা হলো এই যে প্রথম শ্রেণীর প্রতিভার অধিকারী যে তিনজন মহাকবি তাদের মধ্যে মহাকবি কালিদাসের খ‍্যাতির সর্বশ্রেষ্ঠ

কারণ –উপমা প্রয়োগের নিপুণতা,ভারবিরখ‍্যাতি অর্থগৌরবযুক্ত বাক্য প্রয়োগ এর জন্য এবং শ্রী হর্ষের লালিত্য পূর্ণ যুক্ত পদ প্রয়োগের জন্য। কিন্তু মাঘ কবির কাব্যে অলঙ্কারশাস্ত্রোক্ত দশটি গুণ ছাড়াও রয়েছে পূর্বোক্ত তিনজন মহাকবি রূপে স্বীকৃত যে তিনটি গুণ- যথা ত্রুটিপূর্ণ উপমা প্রয়োগ, অর্থগৌরব এবং পদলালিত‍্যপূর্ণ তাদের্র অপূর্ব সমাবেশ। তাই বিস্ময়বিমুগ্ধ এক প্রাচীন সমালোচকের উক্তি-


দুর্লভাঃ খলু কাব‍্যেষু শ্লোকা দশগুর্নৈযুতা।
ভট্টাবেকো রঘৌপঞ্চ মাঘে সন্তি ত্রয়োদশ।।

উপমাপ্রয়োগ

কাব্য শাস্ত্রে সমস্ত অলংকারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল উপমা। তাই উপমার প্রাধান্য অবিসংবাদিত। এটি হল অখিলকাব্যসৌন্দর্য‍্যের উৎস। উপমার লক্ষণ – সাম‍্যং বাচ‍্যমবৈধর্ম‍্যং বাক‍্যৈকে উপমা দ্বয়োঃ।’ একটি বাক্যে সাধর্ম‍্য সূত্রে আক্ষিপ্ত দুই ভিন্ন জাতীয় বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক বৈধর্ম‍্যের অনুল্লেখ এবং কেবল সাধর্ম‍্যের উল্লেখের দ্বারা বিশিষ্ট সৌন্দর্যের প্রকাশ হলে তাকে উপমা বলে।

মাঘকাব্যে সুনিপুণ উপমা প্রয়োগের উদাহরণ শিশুপালবধ এর প্রথম সর্গে দেবর্ষি নারদের দিব‍্য কান্তির বর্ণনায় কবি বলেছেন-


নবানধোঅধো বৃহতঃ পয়োধরান সমূঢ়কর্পূরপরাগপান্ডুরম্।
ক্ষনং ক্ষনোৎক্ষিপ্তগজেন্দ্রকৃত্তিনী স্ফুটোপমং ভূতিসিতেন শম্ভুনা।।

অর্থাৎ বর্ষাকালীন নতুন বৃহৎ মেঘখন্ডের নিকট রাশিকৃত কর্পূর চূর্ণের ন‍্যায় ক্ষুদ্র বর্ণ ছিলেন নারদ। নৃত্য উৎসবের সময যার পৃষ্ঠলম্বিত গজচর্মের উত্তরীয় উর্দ্ধে উঠেছিল ও ভস্মরাগে অঙ্গশুভ‍্র ছিল এমন মহাদেবের সঙ্গে ক্ষনকালের জন‍্য নারদের স্পষ্ট সাদৃশ্য দেখা গিয়েছিল। আর একটি উপমা প্রয়োগ এর উদাহরণ হল-


“দর্পানমম্ভোরুহকেশরদ‍্যুতীর্জটাঃ শরচ্চন্দ্রমরীচিরোচিষম্।
বিপাকপিঙ্গাস্তুহিনস্থলীরুহো ধরাধরেন্দ্রং ব্রততীততীরিব।।”

অর্থাৎ, পদ্মকেশরের ন্যায় পিঙ্গল বর্ণের জটাধারী শরৎচন্দ্রের মত শুভ্র কান্তি বিশিষ্ট মহর্ষি নারদ কে পরিণতির কারণে পিঙ্গল লতা সমূহ হিমালয়ের ন‍্যায় দেখতে পেলেন।

অর্থগৌরব

অর্থগৌরব শব্দের অর্থ অর্থগতং গৌরবম্। এখানে গৌরব শব্দের অর্থ গুরুত্ব। যেখানে মহাকবির প্রযুক্ত পদ প্রকৃতি-প্রত্যয় বিশ্লেষন সঞ্জাত অভিধাশক্তিলভ‍্য যে প্রতীয়মান অর্থ তাকে অতিক্রম করে লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা শক্তির দ্বারা প্রতীয়মান মহাকবির অভিপ্রেত এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে সেখানেই অর্থ গৌরবগুনের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয।

কবি ভারবির কিরাতার্জুনীয়ম্ মহাকাব্যে প্রতি পদে পদেও গৌরব পূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করেছেন।

প্রথম সর্গে দ্রৌপদী বলেছেন –


” বিহায় শান্তিং নৃপ! ধামতৎপুনঃ
প্রসীদ সন্ধেহি বধায় বিদ্বিষাম্।
ব্রজন্তি শত্রুনবধূয় নিঃস্পৃহাঃ
শমেন সিদ্ধিং মুনয়ো ন ভূভৃতঃ।।”

কবি মাঘ তার শিশুপালবধ মহাকাব্যে অর্থগৌরবপূর্ণ প্রচুর বাক্য ব্যবহার করে প্রথম সর্গে রাবনের অভিমানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-

“অমানবং জাতমজং কুলে মনোঃ প্রভাবিনং ভাবিনমন্তমাত্মনঃ।
মুমোচ জানন্নপি জানকীং ন যঃ সদাভিমানৈকর্বনা হি মানিনঃ।।”

অর্থাৎ হে কৃষ্ণ আপনি অতি মানব জন্ম রোহিত এবং ভগবান মনুর বংশের জাত নিজের বিনাশের কারণ জেনেও এই রাবণ সীতাকে মুক্ত করে দেননি অভিমানী ব্যক্তিগণ অভিমানকেই একমাত্র ধন বলে গণ্য করেন।

পদলালিত‍্য

মহাকবি মাঘের দ্বিতীয় গুণ হল পদলালিত‍্য। পদলালিত‍্য শব্দের অর্থ সুকুমারতা গুণযুক্ত পদবিন্যাস এটি বৈদর্ভীমার্গের প্রাণস্বরূপ যে দশটি গুণ তাদের অন্যতম সুকুমারতার লক্ষণ –

“কোমলাক্ষরবাহুল‍্যং বদন্তি সুকুমারতাম্(ক্রমদীশ্বর)।
অনিষ্ঠুরাক্ষর প্রায়ং সুকুমারমিহেষ‍্যতেং।।(কাব‍্যাদর্শ)।

সুতরাং পদলালিত‍্য কোমল অক্ষরযুক্ত পদের বহুল প্রয়োগকে বোঝায। এক্ষেত্রে নৈষধচরিতের রচয়িতা শ্রী হর্ষের মত মহাকবি মাঘও শিশুপালবধ মহাকাব্যে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন।উদাহরণস্বরূপ কাব্যের প্রথম সর্গে ষড়ঋতু কিভাবে রাবণকে সেবা করছে তার বর্ণনায় কবি বলেছেন-


“তপেন বর্ষাঃ শরদা হিমাগমো বসন্তুলক্ষ‍্ম‍্যা শিশিরঃ সমেত‍্য চ।
প্রসূনকণপ্তিং দর্বতঃ সদর্তবঃ পুরেঅস‍্য বাস্তব‍্য কুটুম্বিতাং যযুঃ।।”

রাবনের লঙ্কা নগরীতে ঋতু সমূহ কুশন বিকাশ ঘটিয়ে অবস্থান করতো গ্রীষ্মকালের সঙ্গে বর্ষা,শরৎকালের সঙ্গে হেমন্ত, বসন্তসৌন্দর্যের সঙ্গে শীতকাল প্রতিবেশির মতো মিলিতভাবে অবস্থান করতো। আবার ষষ্ঠসর্গে বসন্ত ঋতুর বর্ণনায় মহাকবির পদলালিত‍্যের চাতুর্য‍্য লক্ষনীয় হয়ে উঠেছে-


“নবপলাফ পলাশবনং পুরঃ স্ফুটপরাগ পরাগতপঙ্কজম্।
মৃদুলতান্ত লতান্তমলোকয়ৎ স সুরভিং স্থরভিং সুমনোহরৈঃ।।”

ধন্ব‍্যালোকে আনন্দবর্ধন এর মতে ধ্বনি রুপা ভারতী মহাকবি মাঘের অনন্য বৈশিষ্ট্য নারীর দেহে হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গ ছাড়াও লাবণ্য বলে যেমন একটা পৃথক অথচ সর্বপ্রধান বস্তু থাকে যা তাকে লাবণ্যময়ী ও আকর্ষণীয় করে তোলে তেমনি মাঘের মহাকাব্যে শব্দ অর্থগুন অলংকার প্রভৃতি ছাড়াও ধ্বনিরূপ একটা বস্তু আছে তা পরিশেষে অনুভূতির বিষয় হয়ে আনন্দ অনুভূতি হযে কাব‍্যরসিকদের মনকে তৃপ্তি দেয়।সুতরাং কালিদাসের উপমা।ভারবির অর্থগৌরব ও নৈষধকারের পদলালিত‍্যের সমাবেশে রচিত মাঘের মহাকাব্য রমনীয়তার ও অভিনবত্বে, সহৃদয় কাব‍্যরসিকদের চিত্তকে এমনভাবে আপ্লুত করেছে যার প্রশংসায় মহাকবির সম্পর্কে তাদের এইসব প্রশংস উক্তি- “মাঘে সন্তি ত্রয়ো গুণাঃ’ সর্বাংশে সার্থক হয়েছে।

Comments